Sunday 21 September 2014

হ্যাঁ আপনাকেই বলছি ! সঠিক মাখরাজ ও তাজবিদের সঙ্গে বিশুদ্ধভাবে আল কুরআন পাঠ করতে পারেন তো ? [ মাসিক নুর- সেপ্টেম্বর সংখা ]

                       লেখক :  মাওলানা মুহাম্মদ এ কে আজাদ










                       সম্মানিত ভাই ও বোন ! মহাগ্রন্থ  আল-কুরআন কি আমাদের জন্য অনণ্য  জীবন বিধান নয় ? মহা প্রজ্ঞাময় এই মহাগ্রন্থ  কি একমাত্র বিশ্ব সংবিধান নয় ? এই  জ্ঞানগর্ভ মহাগ্রন্থ  কি অতীত-ভবিষ্যতের সংবাদ, বর্তমানের জীবন-নির্দেশনা এবং হেদায়েতের মশাল নয় ? আল্লাহ পাক কি বলেন নি যে, “ইহা সেই গ্রন্থ যাতে কোনোই সন্দেহ নেই এবং ইহা ধর্ম-ভীরুদের জন্য পথ- প্রদর্শনকারী “[ সূরা আল-বাকারা - আয়াত নং ১-২] ? তাহলে, আল-কুরআনের প্রতি আমাদের সীমাহীন উদাসীনতা কেন ?


       
           মুসলিম সমাজের তিনটি ক্যাটেগরি:    সম্মানিত ভাই ও বোন ! ‘বিশুদ্ধভাবে আল কুরআন পাঠ’ এর নিরিখে আমরা মুসলিম সমাজকে তিনটি ক্যাটেগরিতে বিভক্ত করতে পারি :

.   একটি শ্রেনী , উলেমা সমাজ। এ সম্পর্কে এঁরা হলেন সুদক্ষ এবং শিক্ষক-স্থানীয় ।
.    দ্বীতিয় শ্রেনী হল, ঐ সব মানুষ যারা আল কুরআন সম্পর্কে সম্পুর্ণ অজ্ঞ ।
গ   তৃতীয় শ্রেনী হল ঐ সব লোকজন যারা কোনক্রমে আল কুরআন পাঠ করতে পারেন বটে, কিন্তু মাখরাজ, তাজবিদ ও ব্যকরণ সম্পর্কে সম্পুর্ণ অসচেতন ।



         দ্বীতিয় ক্যাটেগরির করুন চিত্র : এখন বাস্তব চিত্র হল, বিশেষতঃ আমাদের পশ্চিমবঙ্গে, প্রতি এক  হাজার মুসলিমের মধ্যে নয় শত পঞ্চাশ জন দ্বীতিয় ক্যাটেগরির অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ যারা আল কুরআন সম্পর্কে সম্পুর্ণ অজ্ঞ  । প্রায় প্রতিটি বাড়ীতেই কুরআন  আছে, কিন্তু আছে আলমারিতে । মনোরম কাপড়ে সুসজ্জিতএই কুরআন আলমারি থেকে বের হয় কখন ? বের হয়,যখন প্রতিবেশীর সঙ্গে বিবাদ বাঁধে এবং কুরআন ষ্পর্শ করে শপথ নেওয়ার প্রয়োজন হয় তখন কিংবা যখন গৃহে কেঊ ইনতেকাল করেন তখন। চল্লিশা উপলক্ষে । মৃত ব্যক্তির ঈসালে  সওয়াব নিঃসন্দেহে ভাল কর্ম কিন্তু, কেবল কেউ ইনতেকাল করলে তবেই আল কূরআন পাঠ করতে হবে, এই সংষ্কার সমাজকে জড়বস্তুতে পরিণত করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্টজনৈক কবি “ কুরআন কি ফারিয়াদ” কবিতায় কি হৃদয়-স্পর্শি মর্ম-বেদনাই না প্রকাশ করেছেন !
                      “ তাকো মে সাজয়া যাতা হুঁ
                         আখোঁ সে লাগায়া যাতা হুঁ
                        তাবিজ বানায়া যাতা হুঁ
                        ধো ধো কে পীলায়ে যাতা হুঁ”



          তৃতীয় ক্যাটেগরির পীড়াদায়ক চিত্র : প্রতি এক  হাজার মুসলিমের মধ্যে প্রায় পঁয়তাল্লিশ জন হচ্ছেন  তৃতীয় ক্যাটেগরির অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ ঐ সব লোকজন যারা কুরআন পাঠ করতে পারলেও  মাখরাজ, তাজবিদ ও ব্যকরণ সম্পর্কে সম্পুর্ণ অসচেতন এঁরা কেবল কোনক্রমে হোঁচট খেতে খেতে কুরআন পাঠ করতে পারেন । কিন্তু এই কুরআন পাঠ ভীষন ত্রুটিযুক্ত ও বিপজ্জনক। বিশুদ্ধভাবে আল কুরআন পাঠের জন্য তাজবিদ ও মাখরাজ সম্পর্কে ঞান অত্যাবশ্যক । আর ও অত্যাবশ্যক ধারাবাহিক অনূশীলন । সর্বোপরী অত্যাবশ্যক, কোনও সুদক্ষ আলেমের তত্তাবধান । কিন্তু পরিতাপের বিষয় , এই ভাই-গন জানেন-ই না যে তাদের কুরআন পাঠ ত্রুটিযুক্ত ও বিপজ্জনক। বরং কেউ কেউ নিজেকে ইসলামের সংস্কারক এবং ধর্ম-প্রচারক বিবেচনা করেন। কেউ কেউ সগর্বে দাবি ও করেন ।  তাঁরা ‘হামযাহ’ ও ‘আঈ-ন’ এর একই উচ্চারনই করেন ।  তাঁরা ‘সী-ন’, ‘শী-ন’, ‘স্ব-দ’ ও ‘ছা’  এর একই উচ্চারনই করেন । তাঁরা ‘তা’ ও ‘ত্ব’ এর একই উচ্চারনই করেন ।  তাঁরা ‘জী-ম’ ও ‘যা-ল’ এর একই উচ্চারনই করেন । তাঁরা ‘ক্বা-ফ’ ও ‘কা-ফ’ এর ও একই উচ্চারনই করেন । মাদ, গূন্নাহ এর কোন বালাই থাকে না। ইচ্ছামত অক্ষর কে দীর্ঘ ও মাদকে ছোট করা হয়। উল্লেখ্য, এই ত্রুটিসমুহকে আমরা দুভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথমতঃ, ঐসব ভূল যেগুলির জন্য বর্নের সৌন্দর্‍্য নস্ট হয় কিন্তু অর্থের বিকৃতি ঘটে না এবং নামায ও নস্ট হয় না। যেমন, ‘বিসমিল্লাহ’ এর ‘লাম’ কে বারিক বা চিকন না পড়ে পুর বা মোটা পড়া।  দ্বিতীয়তঃ, ঐসব স্পস্ট ভূল যেগুলির জন্য অর্থের বিকৃতি ঘটে এবং নামায ও নস্ট হতে পারে। ‘ক্বুল’ কে ‘কুল’ পাঠ করলে তো অর্থের বিকৃতি ঘটেই। ‘ক্বুল’ অর্থ বলা এবং ‘কুল’ অর্থ খাওয়া । لآ اله الا الله কে ل اله الا الله পাঠ করলে অর্থ সম্পুর্ন পরিবর্তিত হয়ে যায়। লাম এর উপরে মাদ না পড়ে লাইলাহা পাঠ করলে কলেমার অর্থ হয়ে যাবে, ‘আল্লাহ ছাড়া অবশ্যই উপাস্য আছে’ [ নাউজুবিল্লাহ]।  জনৈক ব্যক্তি নিজের অতীত অজ্ঞতা স্বীকার করে বলেন, 




          জরুরী আত্ম-বিশ্লেষন ও আত্ম-সমীক্ষা : সম্মানিত ভাই ও বোন ! বর্তমান মুসলিম বিশ্বের সব সমস্যার অন্যতম মৌলিক কারন হল আল কুরআন সম্পর্কে আমাদের এই সীমাহীন উদাসীনতা ও নির্মম অজ্ঞতা ।  মহাগ্রন্থ  আল-কুরআন হল আমাদের প্রতি আলাহর পক্ষ থেকে একটি পবিত্র আমানত এবং আমাদের সংকটের  রুদ্ধদ্বার উন্মুক্ত হওয়ার সোনালি সোপান হলো  কুরআন শিক্ষা অথচ আমরা অপ্রয়োজনীয় জিনিসের ন্যয় আল কুরআনকে  অবজ্ঞা অবহেলায় ফেলে রেখে বাহ্যিক পার্থিব উন্নতির লক্ষ্যে খ্রিস্টান, ইহুদি ও হিন্দুদের  অনুসরণ করা শুরু করেছি । আমরা কুরআনকে ত্যাগ করেছি এবং হাতে নিয়েছি গানের বাদ্যযন্ত্র ও বিনোদনের সমূহ উপাদান।

    * *  *    সম্মানিত ভাই ও বোন ! আমরা কেমন তওহিদ-পন্থী যে আমরা চায়ের দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা পরচর্চা করে সময়কে হত্যা করতে পারি, কিন্তু একঘন্টা কোন আলেমের নিকটে বসে কুরআন শিক্ষা করতে পারি না !

    * *  *     আমরা কেমন আশিকে রসুল যে আমরা রকে আর আড্ডায় বসে ঘন্টার পর ঘন্টা এর-ওর গীবত করে সময়কে অতিবাহিত করতে পারি কিন্তু নিজ মসজিদের ইমাম সাহেবের নিকট একঘন্টা বসে কুরআন শিক্ষা করতে পারি না !

    * *  *    আউলিয়ায়ে কেরামের আমরা কেমন অনুরাগী যে আমরা বিশ্বকাপ ফুটবলে নেইমার-মেসী-রোনাল্ডোদের খেলা দেখার জন্য সারা রাত জেগে থাকতে পারি কিন্তু কুরআন শিক্ষার জন্য একটা ঘণ্টা সময় বরাদ্দ করতে পারি না!
    * *  *     আহলে বাইতের আমরা কেমন প্রেমিক যে আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা বোকা-বাক্সের সামনে বসে অ্যানজেলা জুলি – জুলিয়া রবার্টস - শাহরুখ খান – অজয় দেবগণ – ক্যাটারিনা কাইফ – প্রিয়াঙ্কা চোপড়া – দেব- কোয়েল মল্লিক প্রমুখ নর্তক- নর্তকীগন অভিনীত   বলিউড – হলিউড – টলিউডের সিনেমাগুলি উপভোগ করতে পারি কিন্তু কুরআন শিক্ষার জন্য খানিক-ক্ষন মাত্র সময় আমরা ব্যয় করতে পারি না !
     * *  *     সাহাবায়ে কেরামের আমরা কেমন আনুসারী যে, শার্লক হোমস – বোমকেশ বক্সীর অ্যাডভেঞ্চার আর উইলিয়ম শেক্সপিয়র – রবীন্দ্রনাথের রচনাবলী আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে পড়তে পারি কিন্তু কুরআন শিক্ষার জন্য নামমাত্র সময় আমরা বরাদ্দ করতে পারি না!
      * *  *     আমরা কেমন পরকালের যাত্রী যে আমরা পার্থিব উন্নতির জন্য আমাদের আদরের শিশুদেরকে ইংরেজীর টিউশন দিচ্ছি , অংকের টিউশন দিচ্ছি, বাংলার টিউশন দিচ্ছি, লাইফ সায়েন্সের টিউশন দিচ্ছি, ফিজিকাল সায়েন্সের টিউশন দিচ্ছি, কেমিস্ট্রির টিউশন দিচ্ছি, ভূগোলের টিউশন দিচ্ছি, এমনকি ইতিহাসের ও টিউশন দিচ্ছি, কিন্তু পরকালে সাফল্যের পরশমণি কুরআন শিক্ষার জন্য কোন আলেম সাহেবের নিকট টিউশন দেওয়ার কথা বিবেচনা-যোগ্য ও মনে করি না !


             প্রশ্ন হল -  কেন, কেন এত উদাসীনতা ? আল্লাহ পাক কি বলেন নি যে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে।” [সূরা আয-যুমার: আয়াত নং-  ১] ? আল্লাহ পাক কি বলেন নি যে এতদসম্পর্কে যদি তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকে যা আমরা আমাদের বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, তাহলে এর মত একটি সূরা রচনা করে নিয়ে এস আর তোমাদের সেসব সাহায্যকারীদেরকে সঙ্গে নাও-এক আল্লাহকে ছাড়া, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো।” [সূরা আল-বাকারা: আয়াত নং- ২৩] ?  আল্লাহ পাক কি বলেন নি যে , “ এটি একটি গ্রন্থ, যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে আপনি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন , পরাক্রান্ত, প্রশংসার যোগ্য রবের নির্দেশে,  তাঁরই পথের দিকে।” [সূরা ইবরাহীম: আয়াত নং-  ১] ?  আল্লাহ পাক কি বলেন নি যে  অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের প্রতি একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, িনি  তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেযদিও তারা ইতঃপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিল। [সূরা আলে-ইমরান: আয়াত নং- ১৬৪]


       সম্মানিত ভাই ও বোন ! আসুন নিজে সঠিক মাখরাজ ও তাজবিদের সঙ্গে বিশুদ্ধভাবে আল কুরআন পাঠ করতে শিখি এবং নিজের সোনামণি-দেরকেও শিখাই। কি অব্যক্ত যন্ত্রনায় না লিখা হয়েছে:  
                     “ মুঝ কো ভি পাড়হ, কিতাব হুঁ
                       মাজমুনে খাস হুঁ
                      মানা তেরে নিসাব মে সামিল নাহি হুঁ মাই...”

     আস্ স্বলাতু  ওয়াস সালামু আলাইকা ইয়া রসুলাল্লাহ !



No comments:

Post a Comment